Published Date : 11th Dec, 2025 Published by Scolars Bangladesh Scoiety
ডেট্রয়েট একসময় আমেরিকার ইঞ্জিন হিসেবে পরিচিত ছিল। মিশিগান নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এই শহরটি ছিল অটোমোবাইল শিল্পের প্রাণকেন্দ্র। ফোর্ড, শেভরোলেট আর পন্টিয়াকের কারখানাগুলো এই শহরকে গড়ে তুলেছিল শিল্পের মহানগর হিসেবে। কিন্তু সময়ের স্রোতে সেই গৌরব মলিন হয়ে যায়। কারখানাগুলোর চিমনি থেমে যায়, অ্যাপার্টমেন্ট ফাঁকা হতে থাকে, আর মানুষের মুখে জমতে থাকে বেকারত্বের ক্লান্তি।
তবুও মিশিগানের এই শহরে থেমে থাকেনি মানুষের আসা। ভাঙনের মাঝে নতুন করে বাঁচার আশায় বহু অভিবাসী এখানে বসতি গড়েছে। বাংলাদেশিরাও এসেছে পরিবার নিয়ে, এসেছে একাকী শিক্ষার খোঁজে কিংবা জীবিকার সন্ধানে। তারা কেউ ডেট্রয়েটের সাবার্বে বাস করতেন, কেউবা ইউনিভার্সিটি অব ডেট্রয়েটে লেখাপড়া করতেন, কেউ অটো মেকানিক, কেউ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। এদের হাত ধরেই মিশিগানে গড়ে ওঠে এক খণ্ড বাংলাদেশ। সেই শহরেই, এক সকালে, থেমে যায় একজন নারীর সম্ভাবনাময় পথচলা।
ফারজানা চৌধুরী। ঢাকার একটি উচ্চশিক্ষিত পরিবারে ফারজানার জন্ম। বুয়েট থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক সম্পন্ন করে তার লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা। ১৯৯৯ সালে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ডেট্রয়েট মের্সিতে মাস্টার্সে ভর্তি হন। স্বামী আনামুল্লাহ এবং মাত্র তিন মাস বয়সী যমজ দুই পুত্রকে রেখে একা পাড়ি জমান তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসে প্রথমে তার লড়াই ছিল কঠিন। ভাষা, সংস্কৃতি আর নিঃসঙ্গতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু অধ্যবসায় আর প্রতিভায় অচিরেই জয় করে নেন সবাইকে। পড়ালেখা শেষে ২০০১ সালে ডিগ্রি লাভ করেন এবং ২০০২ সালের শুরুর দিকে জেনারেল মোটরসের একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি পান। এর পরই পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসার প্রস্তুতি শুরু করেন। এপ্রিল ২০০২ স্বামী আনামুল্লাহ ও যমজ সন্তানরা এসে পৌঁছায় ডেট্রয়েটে।
এই অভিবাসনের আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একই অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে বাস করতেন এম এস কামাল। তিনি বুয়েটেরই একজন প্রাক্তন ছাত্র, ফারজানার সিনিয়র এবং বাংলাদেশের একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের পুত্র। ফারজানা ও কামালের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা জন্মায়। এটি পেশাগত না ব্যক্তিগত তা নিয়েই প্রশ্ন তৈরি হয় আনামুল্লাহর মনে।
সন্দেহ, অভিযোগ আর বাকবিতণ্ডা ছিল যেন প্রতিদিনের সঙ্গী। আনামুল্লাহ একাধিকবার ফোন কলে ফারজানাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। রাত করে বাইরে যাওয়া নিয়ে তীব্র আপত্তি তোলেন। এমনকি কামালের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করতে চান। বিষয়টি নিয়ে তিনি স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির সিনিয়রদের কাছে সাহায্য চান এবং দুবার শালিশ বসান। কিন্তু ফারজানা স্পষ্ট করে বলেন, এটি আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়, এতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারো নেই।
১৫ জুলাই ২০০২। ভোর তিনটা। শহরের বাতাসে গ্রীষ্মের হালকা গরম। হঠাৎ ফারজানা আনামের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ভেসে আসে তর্কের শব্দ, চিৎকার এবং আসবাবপত্র সরানোর মতো আওয়াজ। প্রতিবেশী শোভন চক্রবর্তী, ইউনিভার্সিটি অব ডেট্রয়েটের ছাত্র, দরজা খুলে দেখেন আনামুল্লাহ রক্তমাখা অবস্থায় দাঁড়িয়ে, আর ফারজানার দেহ মেঝেতে রক্তের হ্রদে পড়ে আছে।
আনামুল্লাহর নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ঝগড়ার এক পর্যায়ে তিনি রান্নাঘর থেকে একটি ছুরি নিয়ে আসেন এবং ফারজানার বুক ও পেটে আঘাত করেন। তারপর নিজেই ৯১১ নম্বরে কল করে বলেন, আমি আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলেছি।
ফারজানাকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। দুই শিশুকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় শিশু সুরক্ষা সংস্থায়।
আনামুল্লাহর বিরুদ্ধে প্রথম ডিগ্রি হত্যার অভিযোগ আনা হয়। মিশিগান রাজ্যে মৃত্যুদণ্ড নেই, তাই তাকে জীবনব্যাপী কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং এতে প্যারোলের সুযোগ নেই। প্রতিবেশীরা স্বাক্ষ্য দেন যে আনামুল্লাহ পূর্ব থেকেই হুমকি দিচ্ছিলেন এবং তিনি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না।
ফারজানার পরিবার দুই যমজ শিশুকে বাংলাদেশে নিয়ে যায়। কামাল ডেট্রয়েট ছেড়ে টেক্সাসে চলে যান। তার পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি।
আনামুল্লাহ আজও মিশিগানের স্টেটভিল কারাগারে বন্দি। তার প্যারোলের আবেদন বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
ফারজানার গল্প কেবল ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির নয়, এটি সম্পর্কের ভাঙন, আবেগের অনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ এবং ভুল সিদ্ধান্তের নির্মমতার প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি শহরেই কিছু নাম বাতাসে ভাসে, যাদের গল্প শেষ হলেও অনুরণন থেকে যায়। ফারজানা সেইসব নামের একটি।
Do you think that the non-resident Bengalis should have the right to vote in the upcoming election? Justify your answer. What do you think will be the proper way to implement the voting system?